৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার,বিকাল ৫:৪৩

পদ্মা সেতুর এক বছর : পাল্টে গেছে বাগেরহাটের অর্থনীতি

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২৩

  • শেয়ার করুন

আলী আকবর টুটুল : ঢাকা রাজধানীর সাথে দক্ষিনাঞ্চলের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সড়কপথ।সড়ক পথের পদ্মাসেতু বর্ষপুর্তি আজ রোববার (২৫) জুন) । ২০২২ সালের এই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি উদ্বোধন করেন। গত এক বছরে এটি দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। সেতুটির সুফল ভোগ করা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম বাগেরহাট।  গেল এক বছরে শিল্প করকারখানা, চিংড়ি-সাদামাছ, সবজি ও পযটন শিল্পে আমুল পরিবর্তন এসেছে।কর্মসংস্থানও বেড়েছে কয়েকগুন। দিনে দিনে পরিবহন দূরপাল্লার বাস ও পন্য পরিবহনের ক্ষেত্রে মোংলা বন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসা বানিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

মোংলা বন্দর:

পদ্মাসেতু চালুর পরে মোংলা বন্দরের ব্যবস্থা বেড়েছে কয়েকগুন। ঢাকা থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রাম বন্দরের থেকে মোংলা বন্দরের দূরত্ব কম হওয়ায় পন্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা মোংলা বন্দরের দিকে ঝুকে পড়ছেন। ইতোমধ্যে প্রথমবারের মত গার্মেন্টস পন্য রপ্তানি শুরু হয়েছে এই বন্দর থেকে। এক বছরে ৫টি জাহাজে করে বিপুল পরিমান তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে মোংলা বন্দর দিয়ে। পাশাপাশি কন্টেইনার বাহী জাহাজের আগমন বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থ বছরে যেখানে কন্টেইনার বাহী জাজাজ এসেছিল ৪৫টি, এবার এসেছে ৫২টি।

মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ৬ হাজার ২৫৬ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী। তিনি বলেন, বর্তমানে বন্দর এলাকায় ১১টি এলপিজি কারখানা, ৫টি সিমেন্ট কারখানা ও বিভিন্ন ধরণের ১০টি শিল্প কারখানা রয়েছে। বন্দরের ২৫৮ একর জমিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল বেপজা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পদ্মাসেতুর মধ্য দিয়ে মোংলা বন্দরের ব্যস্ততা বেড়েছে কয়েকগুন। বিদেশী জাহাজের আগমন-নির্গমন বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

পযটন শিল্পঃ

দুটি বিশ্ব ঐতিহ্যের জেলা বাগেরহাট আগে থেকেই পযটন শিল্পে সম্মৃদ্ধ। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় কাঙ্খিত দর্শনার্থী আসতেন না এখানে। পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পরে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ ও সুন্দরবনে উল্লেখযোগ্য হারে দর্শনার্থী ও রাজস্ব আয় বেড়েছে সরকারের ।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন বলেন, পদ্মাসেতু চালুর মধ্য দিয়ে সুন্দরবনে পযটন খাতকে আরও এগিয়ে নিতে বনের মধ্যে চারটি ইকোটুরিজম কেন্দ্র নির্মান চলছে। যার কাজ সমাপ্তির পথে।তবে গেল এক বছরে দেশী-বিদেশী দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুন।  গেল এক বছরে সুন্দরবনে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৩৮ জন দেশী ও ১ হাজার ৬৭৫ বিদেশী দর্শনার্থীর আগমন ঘটেছে। যার মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে এক কোটি ৮৭ লক্ষ ৬৭ হাজারে টাকা। যা গেল বছরের তুলনায় দ্বিগুন। তিনি আরও বলেন, নতুন চারটি ইকোটুরিজম কেন্দ্র চালু হলে সরকারের রাজস্ব ও দর্শনার্থীর আগমন কয়েকগুন বেড়ে যাবে।

এদিকে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ও প্রাচিন আমলের পুরাকৃতি দেখতে দেশী-বিদেশী দর্শনার্থীদের সমাগম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্নতত্ব বিভাগের কাস্টোডিয়ান মোহাম্মাদ যায়েদ।

তিনি বলেন, পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর ষাটগম্বুজ দেখতে চার লাখ ৯৬ হাজার ৮জন দেশী ও ১ হাজার ৪৮২ জন বিদেশী দর্শনার্থী এসেছেন। যার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৭ লক্ষ টাকা। গেল বছর অর্থ্যাৎ ২০২১-২২ অর্থ বছরে দেশী দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ১৫ হাজার এবং বিদেশী দর্শনার্থী ছিল ২৮৯ জন। এছাড়া পযটন খাতকে এগিয়ে নিতে নানা পরিকল্পনা চলছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

মৎস্য সেক্টরঃ পদ্মাসেতু চালুর মধ্য দিয়ে এক বছরে চাহিদা বৃদ্দির সাথে সাথে বাগেরহাটে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ১০ শতাংশ।অল্প সময়ের মধ্যে এই জেলায় উৎপাদিত বাগদা, গলদা, রুই, কাতলসহ বিভিন্ন প্রকার সাদা মাছ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌছে যাওয়ায় ভাল দাম পাচ্ছেন চাষীরা। চাষীদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও লাভবান হচ্ছেন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, পদ্মাসেতুর ফলে বাগেরহাট জেলার মৎস্য সেক্টর নতুন করে আশার আলো দেখছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় যেমন বেড়েছে তাজা মাছের চাহিদ, তেমনি চিংড়ি, কাকড়া ও কুচিয়া রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সাদা মাছের দাম কেজি প্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষীরা উৎসাহিত হচ্ছেন মাছ চাষে। অন্যদিকে রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি, কাকড়া ও কুচিয়ার দামও বেড়েছে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। গেল বছর জেলায় ৯৯ হাজার মেট্রিক টন সাদা মাছ উৎপাদন হলেও, এবছর উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে এক লক্ষ ১০ হাজার মেট্রিক টন। চাষী পর্যায়ে উৎপাদন এর থেকে বশে হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

কৃষি সেক্টরঃ

পদ্মাসেতু চালুর মধ্যে দিয়ে কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ছোয়া লেগেছে। উৎপাদনও বেড়েছে পাঁচ শতাংশ। এছাড়া উৎপাদিত সবজি সহজে বাজারজাত করায় কৃষকদের নায্যমূল্য নিশ্চিত হয়েছে। যার ফলে দিনদিন আরও সবজি চাষে ঝুকছেন স্থানীয়রা। গেল বছর যেখানে হেক্টর প্রতি সবজির উৎপাদন ছিল ২০ মেট্রিকটন, সেখানে বর্তমানে ২৫ মেট্রিকটন সবজি উৎপাদন হচ্ছে।

যার ফলে কৃষকদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের উপ-পরিচালক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মাসেতু চালুর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকার আসায় কৃষকদের সবজি সহজে বিক্রি হয়ে যায়। কোন সবজি নষ্ট হওয়ার শঙ্কা নেই। এছাড়া অনেক কৃষক নিজেই রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে সবজি সরবরাহ করে আসছে। এক কথায় পদ্মাসেতু চালুর মধ্য দিয়ে কৃষি ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন এসেছে।

যোগাযোগঃ

পদ্মাসেতু চালুর মধ্য দিয়ে বাগেরহাটের সাথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। বেড়েছে যাত্রীবাহী বাস ও পন্য পরিবহনকারী যানবাহন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অনেকের। রাজধানী থেকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে  দিনে দিনে বাড়ি ফিরে আসার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে জেলা বাসীর।

বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তালুকদার আব্দুল বাকি বলেন, পরিবহন সেক্টরের বড় স্বপ্ন ছিল পদ্মা সেতু। এই সেতু চালুর মধ্য দিয়ে যেমনি পরিবহন সেক্টর অনেকটা এগিয়ে গেছে, তেমনি যাত্রীদেরও যাতায়েত ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। বেড়েছে বিলাসবহুলসহ দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা। বাগেরহাট থেকেই সরাসরি পদ্মাসেতু হয়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুর, ঠাকুরগাও, বগুরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এক সময়ের চিরচেনা মাওয়া ঘাটের  এখন আর ভোগান্তি নেই।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাহসীকতায় পদ্মাসেতু নির্মানের ফলে দক্ষিনাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেছে। এই অঞ্চলের মানুষের সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হয়েছে। মোংলা বন্দরকেন্দ্রিক নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। এছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা, পযটন, কৃষি, মৎস্য ও বিভিন্ন ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন এসেছে। যার সুফল এখন দৃশ্যমান। পদ্মাসেতু ঘিরে এই অঞ্চলে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন জেলার এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

পদ্মা সেতু নির্মান :
বাংলাদেশের ইতিহাসে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। দুইস্তর বিশিষ্ট ইস্পাত ও কংক্রিট নির্মিত এই সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় তৈরি সেতুটি ৪১টি স্প্যান নিয়ে গঠিত, প্রতিটি স্প্যান লম্বায় ১৫০ দশমিক ১২ মিটার বা ৪৯২ দশমিক ৫ ফুট এবং চওড়ায় ২২ দশমিক ৫ মিটার বা ৭৪ ফুট। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার বা ৩ দশমিক ৮২ মাইল। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। ১২০ মিটার বা ৩৯০ ফুট গভীরতাযুক্ত বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু এটি।
 
পদ্মা সেতুর ঋণ পরিশোধ

পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের ৩য় ও ৪র্থ কিস্তির ৩১৬ কোটি ২ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩ টাকা পরিশোধ করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। ১৯ জুন (সোমবার) সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের কাছে এ টাকা তুলে দেন সেতু সচিব মো. মনজুর হোসেন।

এর আগে, গত ৫ এপ্রিল  ১ম ও ২য় কিস্তির মোট ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার ৫০ টাকা পরিশোধ করা হয়। এর ফলে প্রথম বছরে সর্বমোট ৬৩২ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৪৩ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় পুরো অর্থ বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে ঋণ হিসেবে দিয়েছে অর্থ বিভাগ।

  • শেয়ার করুন